বাংলার মানুষের কাছে বেনারশী শাড়ি মানেই এক ধরনের আভিজাত্যের ছোঁয়া। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরের ১১ ও ১২ নম্বর বেনারশী পল্লী হিসেবে ব্যাপকভাবে পরিচিত। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ ঈদ, বিয়ে কিংবা বিশেষ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে এখানে শাড়ি কিনতে আসেন। কিন্তু কীভাবে এখানে গড়ে উঠল এমন সমৃদ্ধ শিল্প? এর আগে আসুন জেনে নিই বেনারশী শাড়ির নাতিদীর্ঘ জন্মকথা। বেনারশী শাড়ির মূল উৎপত্তিস্থল হিসেবে ভারতের বেনারশ শহরের নাম শোনা যায়। এই শাড়ি মানবচালিত একটি যন্ত্রের সাহায্যে তৈরি করা হয়। যাকে বলা হয় তাঁত। আর কারিগরদের বলা হয় তাঁতী। ভারতের বেনারশ শহরে বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম তাঁতী। কিন্তু ঠিক কবে থেকে তারা বেনারশী শাড়ি তৈরি করে আসছেন তা জানা যায় নি। এ নিয়ে একটি গল্প শোনা যায়। তাঁতীদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন আনসারী। ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হয়রত মুহাম্মদ (সঃ) যখন মক্কা থেকে মদীনায় যান তখন এই আনসারী সম্প্রদায়ের কাছে আশ্রয় নেন। পরবর্তীতে তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে এবং এর প্রচারেও অংশ নেয়। মনে করা হয়, বেনারশ শহরের সিংহভাগ তাঁতী সেই আনসার সম্প্রদায়ের লোক ছিলেন। আরব থেকে বেনারশ – কিন্তু বেনারশ থেকে এই শাড়ি বাংলায় এলো কিভাবে?

১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় ভারতের বেনারশ থেকে প্রায় ৩০০টি মুসলিম তাঁতী পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে আসেন। তারা মূলত ঢাকার মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসতি স্থাপন করে। তারা তাদের আদিপেশা এই তাঁত শিল্পের কাজ এদেশে এসেও অব্যাহত রাখে। নান্দনিক ডিজাইন, উন্নত রুচি এবং নিপুণ বুননের কারণে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে স্থানীয়রাও এ কাজে যোগদান করলে তা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। ক্রমান্বয়ে তাঁতীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় কারখানাগুলো পুরান ঢাকা থেকে সরিয়ে মিরপুরে নিয়ে আসা হয়।

বর্তমানে মিরপুর ১১ ও ১২ নম্বর সেকশনে শতাধিক বেনারশী শাড়ির দোকান রয়েছে। এখানে ২০-৩০ প্রকারের ডিজাইনের শাড়ি পাওয়া যায়। এসব শাড়ির গুণগত মানও যেমন উন্নত তেমনি দামও চড়া। যেমন - মসলিন বেনারসি ১০০০০-১৫০০০ টাকা, নেট জুট ৫০০০-৬০০০ টাকা, কাতান বেনারসি ১১০০-১৮০০ টাকা, মসলিন কাতান ১০০০০-১২০০০ টাকা, পিয়ান বেনারসি ও খাদি বেনারসি ৭০০০-২৫০০০ টাকা।

বেনারশী শাড়ি তৈরি প্রক্রিয়াও কিছুটা জটিল। আগেই বলা হয়েছে এই শাড়ি তৈরি করা হয় মানবচালিত যন্ত্র তাঁতের মাধ্যমে। এই শাড়ি তৈরির মূল উপাদান কাঁচা রেশম সুতা। এর পাশাপাশি ব্যবহৃত হয় জরি সুতা। বর্তমানে দেশী রেশম সুতার দাম বৃদ্ধির কারণে তাঁতীরা সস্তা চায়না সিল্ক সুতা ব্যবহার করে থাকেন। বিদেশ থেকে আনা সুতা কারিগরেরা প্রথমে রং করেন। তারপর সাবান ও গরম পানি দিয়ে ধুয়ে রৌদ্রে শুকান। এরপর চলে তাঁতে নান্দনিক বুননের কাজ। ডিজাইন ও বুনন সহজ হলে একটি শাড়ি তৈরি করতে একজন তাঁতির সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ।

আবার কঠিন ডিজাইন ও নিখুঁত বুননের কাজ করতে তিনজন তাঁতির তিন মাস সময়ও লেগে যায়! একটি শাড়ি তৈরির হওয়ার পর তা পলিশ করা হয়। বেনারশী শাড়ির রঙের বৈচিত্র্যও লক্ষণীয়। বিভিন্ন রঙের ওপর জমকালো সোনালি-রূপালি জরির কাজ দৃষ্টিনন্দন লাগে । বেনারশী শাড়ির ধরন বা ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে রাখা হয় শাড়ির নাম। যেমন - পিরামিড কাতান, ব্রোকেট কাতান, বেনারশী কসমস, চুনরি কাতান, প্রিন্স কাতান মিরপুরী রেশমি কাতান ইত্যাদি।

কোনো বিয়ে বা জমকালো অনুষ্ঠানে মেয়েদের প্রথম পছন্দের তালিকায় থাকে বেনারশী শাড়ির নাম। তবে বর্তমানে বিভিন্ন বিদেশী পোশাক ও পশ্চিমা রুচির কারণে বেনারশী শিল্প কিছুটা ক্ষতিগ্রস্থ। এছাড়াও এর কারিগরেরা যে অমানুষিক পরিশ্রম করে নিপুণতার সাথে একটি শাড়ি তৈরি করেন তার যথাযথ পারিশ্রামিকও তারা পান না। বেনারশী শিল্প বাংলাদেশের যেমন গর্ব তেমনি এর সঠিক পরিচর্যা করলে এটা হয়ে উঠবে একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক খাত।
আপনি কি সাহায্য পেয়েছেন
সকল মন্তব্য
মন্তব্য করতে লগইন করুন নিবন্ধন করুন